ডায়াবেটিস কী?
ডায়াবেটিস কথাটি আমাদের কাছে বেশ পরিচিত। এমন কোনো পরিবার নেই যেখানে কোনো ডায়াবেটিসের রোগী পাওয়া যাবে না। ডায়াবেটিস এমনই একটি রোগ, যা কখনো সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রাখা যায়। যখন আমরা কার্বোহাইড্রেট বা সাধারণ শর্করাজাতীয় খাবার খাই, তখন তা ভেঙে গ্লুকোজে পরিণত হয়। ইনসুলিন হচ্ছে একধরনের হরমোন। এর কাজ হলো এই গ্লুকোজকে মানুষের দেহের কোষগুলোয় পৌঁছে দেওয়া। এরপর সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে শরীরের কোষগুলো শক্তি উৎপাদন করে। সেই শক্তি দিয়েই রোজকারের কাজকর্ম করে মানুষ। সুতরাং যখন এই গ্লুকোজ শরীরের কোষে পৌঁছাবে না, তখন স্বাভাবিকভাবেই মানুষের দৈনন্দিন কাজ ব্যাহত হবে।
যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন দক্ষতার সঙ্গে (কার্যকরভাবে) ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।
ইনসুলিন মানুষের শরীরের কোষগুলি তে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ একটি “চাবি” হিসাবে কাজ করে। এর দ্বারা আমাদের খাবার থেকে যে চিনি বা শর্করা (গ্লুকোজ) পাওয়া যায়, তা রক্তের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। তারপর, কোষ শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্য সেই গ্লুকোজ ব্যবহার করে। ইনসুলিন তৈরি হয় অগ্ন্যাশয়ের বিশেষ কোষ দ্বারা তৈরি হরমোন আইলেটস (আই-লেটস) থেকে। ডায়াবেটিস-জনিত ইনসুলিনের তারতম্যের জন্য আমাদের রক্তে শর্করার মাত্রার তারতম্য ঘটে। শরীরে বেশ কিছু অস্বাভাবিকতা দেখা দেয়।
অন্যদিকে, ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়ার রোগীর শরীর থেকে প্রচুর পরিমাণ গ্লুকোজ বের হয়ে যায়। এতে করে প্রয়োজনীয় শক্তি উৎপাদন করতে পারে না দেহের কোষগুলো। ফলে রোগী দুর্বলতা অনুভব করেন। রোগী যদি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সঠিক ব্যবস্থা গ্রহণ না করেন, তবে তার রক্তনালি, স্নায়ু, কিডনি, চোখ ও হৃদ্যন্ত্রের সমস্যাসহ নানা ধরনের শারীরিক জটিলতা দেখা দিতে পারে।
ডায়াবেটিসের রূপ:
- টাইপ ১
- টাইপ ২
টাইপ ১ এবং টাইপ ২ হল ডায়াবেটিসের দুটি সাধারণ রূপ। এছাড়া অন্যান্য ধরণেরও ডায়াবেটিস হতে পারে, যেমন গর্ভকালীন ডায়াবেটিস, নিওনাটাল ডায়াবেটিস, জেসটেসানাল ডায়াবেটিস ইত্যাদি।
- টাইপ-১ ডায়াবেটিস:
ভাইরাস এবং ব্যাকটেরিয়াগুলির বিরুদ্ধে লড়াই করতে প্রতিরোধ ব্যবস্থা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তবে, টাইপ ১ ডায়াবেটিসে, ইমিউন সিস্টেম ইনসুলিন তৈরির জন্য দায়ী অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলিকে আক্রমণ করে এবং ধ্বংস করে। এই কারণে আপনার শরীরে খুব কম ইনসুলিন রয়েছে। চিনি কোষে স্থানান্তরিত না হয়ে রক্তে গঠন করে। জিনগত প্রবণতা এবং পরিবেশগত কারণগুলি টাইপ ১ ডায়াবেটিসের জন্য দায়ী। এই ধরনের রোগীদের শরীরে ইনসুলিন একেবারেই তৈরি হয় না। এ রোগে অগ্ন্যাশয়ের ইনসুলিন নিঃসরণকারী কোষগুলো ধ্বংস হয়ে যায়। শিশু ও তরুণদের মধ্যে এ ধরনের বহুমূত্র হয় বেশি। সাধারণত ১০- ৩০ বছর বয়সের মধ্যে এ ধরনের ডায়াবেটিস দেখা যায়। এই ধরনের ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য রোগীকে ইনসুলিন ইনজেকশন বা ইনসুলিন পাম্প নিতেই হয়। অন্যথায় রক্তের শর্করা অতি দ্রুত বেড়ে গিয়ে অল্প সময়ের মধ্যেই রক্তে অম্লজাতীয় বিষক্রিয়ায় অজ্ঞান হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হয়। ইহা মূলত জেনেটিক কারণে হয়ে থাকে।
- টাইপ-২ ডায়াবেটিস:
টাইপ-২ রোগীদের শরীরে কিছু ইনসুলিন তৈরী হয় তবে সেটা প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ঠ নয় অথবা রোগীরা শরীরে যে ইনসুলিন উৎপন্ন হয়, তাকে ব্যবহার করতে পারে না। টাইপ-২ বহুমূত্র রোগের পেছনে থাকে মূলত ‘ইনসুলিন রেজিস্ট্যান্স’। এই শ্রেণীর রোগীর বয়স অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ত্রিশ বছরের ওপরে হয়ে থাকে। সাধারনত এই ধরনের রোগীরা ইনসুলিন নির্ভর নন। এই ধরনের রোগীরা সাধারনত স্থূলকায় হন। খাদ্যাভ্যাসের পরিবর্তন ও নিয়মিত ব্যায়ামের সাহায্যে একে প্রথমে মোকাবিলা করা হয়। তবে অনেক সময় প্রয়োজন হয় মুখে খাওয়ার ওষুধ, এমনকি ইনসুলিন ইনজেকশন। মিষ্টি ও মিষ্টিজাতীয় পানীয়, টাইপ-২ ডায়বেটিস এর ঝুঁকি বাড়ায়। শারীরিক পরিশ্রম না করাও টাইপ-২ ডায়াবেটিসের অন্যতম একটা কারণ। খাবারে চর্বির ধরণও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।স্যাচুরেটেড ফ্যাট ও ট্রান্স-ফ্যাট ঝুঁকি বাড়ায় পক্ষান্তরে পলি-আনস্যাচুরেটেড ও মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট ঝুঁকি কমায়। অত্যধিক পরিমাণ সাদা ভাত খাওয়াও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ায়।
ডায়াবেটিসের লক্ষণঃ
ডায়াবেটিস হলে সাধারণত নিম্নলিখিত লক্ষন ও উপসর্গসমূহ দেখা যায়ঃ
- ঘন ঘন প্রস্রাব হওয়া
- পানি পিপাসা বেশি বেশি লাগবে
- শরীরে ক্লান্তি ও দুর্বলতা অনুভূত হবে
- বেশি বেশি ক্ষুধা পাবে
- স্বাভাবিকভাবে খাওয়া সত্ত্বেও ওজন কমতে থাকবে
- যেকোনো ধরনের ক্ষত শুকাতে স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক দেরী হবে
- নানান রকম চর্মরোগ যেমন খোশ পাঁচড়া, ফোঁড়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে
- চোখে কম দেখা, দৃষ্টিশক্তি কমে যেতে পারে।
ডায়াবেটিসের প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা
ডায়াবেটিস নির্ণয়
- ৪৫ বছরের বেশি বয়সের লোকদের ডায়াবেটিসের লক্ষণগুলি পরীক্ষা করা উচিত এবং রক্তে শর্করার মাত্রা পরীক্ষা করা উচিত। যদি তারা দেখতে পান যে রক্তে শর্করার মাত্রা স্বাভাবিক রয়েছে তবে প্রতি তিন বছর পর পর তাদের পরীক্ষা করা উচিত।
- হার্ট ডিজিজ, উচ্চ রক্তচাপ, বা কোলস্টেরল অস্বাভাবিক মাত্রার মতো অতিরিক্ত ঝুঁকির কারণগুলির মধ্যে 25 এরও বেশি (এশিয়ান আমেরিকানদের জন্য 23)বডি মাস ইনডেক্স (বিএমআই) রয়েছে এমন লোকদের ডায়াবেটিসের জন্য পরীক্ষা করা উচিত।
- গর্ভকালীন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মহিলাদের প্রতি তিন বছরে ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা উচিত।
- প্রিডিবিটিস আক্রান্ত ব্যক্তিকে বছরে একবার টাইপ 2 ডায়াবেটিসের পরীক্ষা করা উচিত।
সকল ধরণের ডায়াবেটিসের চিকিৎসার বিকল্প
স্বাস্থ্যকর খাদ্য
ডায়াবেটিসের জন্য আপনাকে অবশ্যই কোনও নির্দিষ্ট ডায়েট অনুসরণ করতে হবে। শাকসবজি, ফলমূল, গোটা শস্য এবং প্রোটিন হ’ল সুষম ও স্বাস্থ্যকর ডায়েটের সার। এগুলি ফাইবার সমৃদ্ধ এবং শরীরকে পুষ্টি সরবরাহ করে। ডায়েটে ক্যালরি এবং ফ্যাট কম থাকে, কম স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং রিফাইন্ড কার্বোহাইড্রেট থাকে। প্রতিবার এবং পরে ডেজার্ট নিতে হবে।
ব্যায়াম
অনেক লোক দৈনিক ভিত্তিতে ব্যায়াম করে এবং আপনি যদি ডায়াবেটিক ব্যক্তি হন তবে অবশ্যই আপনার অনুশীলনের পরিকল্পনাটি অনুসরণ করা উচিত। অনুশীলন আপনার ইনসুলিন সংবেদনশীলতা উন্নত করে। ফলস্বরূপ, কোষগুলিতে চিনি পরিবহনের জন্য আপনার দেহের কম ইনসুলিনের প্রয়োজন হবে। চিনি কোষে প্রবেশের সাথে সাথে এটি রক্তে শর্করার মাত্রা কমাতে সহায়তা করে। কোষগুলি এই চিনিটি শক্তির জন্য ব্যবহার করে। আপনার প্রতিদিনের রুটিনে অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত করুন। 30 মিনিটের অনুশীলন আপনাকে অনেক সাহায্য করতে পারে।
ডায়াবেটিসে কি কি খাবেন না?
ডায়াবেটিসে কখনই শরীরের প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাওয়া চলবে না।
- যেসব খাদ্য বা পানীয়তে শর্করার পরিমাণ বেশি থাকে সেসব বর্জন করতে হবে।
- কাঁচা লবণ খাওয়া এড়াতে হবে।
- বেশি ভাজা ও তৈলাক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
- অতিরিক্ত চা বা কফি পান বারণ।
- ফ্যাট-যুক্ত দুধ বা দুগ্ধজাত খাবার বর্জন করতে হবে।
- ভাত, আলু, কলা এবং গাজরে শর্করা বেশি থাকে। সুতরাং এই খাবার গুলি খাওয়া নিয়ন্ত্রন করতে হবে।
ডায়াবেটিসে কোন কোন ফল খাওয়া উচিত।
নিম্নলিখিত ফলগুলি ডায়াবেটিসে খাওয়া চলে –
- আপেল
- অ্যাভোকাডো
- পেঁপে
- বেরি জাতীয় ফল
- কামরাঙা
- নাশপাতি
- কমলা
আমাদের দেশে অনেক মানুষ জানেন না যে তিনি প্রি-ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। সঠিক সময় প্রি-ডায়াবেটিস শনাক্ত করতে পারলে এবং প্রতিরোধে কার্যকরী পদক্ষেপ নিলে ডায়াবেটিসসহ অন্যান্য জটিল রোগ থেকে দূরে থাকা সম্ভব।